পর্যালোচক: মো: তামিম সারোয়ার নিঝুম

নীলকর-বিষধর বিষপোরা মুখ,
অনল শিখায় ফেরে নিল যত দু:খ?
অবিচারে কারাগারে পিতার নিধন,
নীলক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হলেন পতন;
পতিপুত্রশোকে মাতা হলেন পাগলিনী ;
স্বহস্তে করেন বধ সুরলা কামিনী!
আমার বিলাপে মার জ্ঞানের সঞ্চার,
একেবারে উথিল-দু:খ-পারাবার।
শোকশুলে মাখা হলো বিষ বিড়ম্বনা,
তখনি মলেন মাতা, -কে শোনে সান্ত্বনা।
~দীনবন্ধু মিত্র (নীলদর্পণ)

দীনবন্ধু মিত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নবজাগরণের সময়কার বাংলা নাটকের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন। তিনি তখনকার গৎবাঁধা আধুনিক বাংলা নাট্যধারার ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামাজিক নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন। এই ধারায় তিনিই প্রথম বাংলা নাটক রচনায় সফলতা অর্জন করেন। এর ফলে তিনি পরবর্তীকালের নাট্যকারদের অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হন।

দীনবন্ধু মিত্রের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো নীলদর্পণ, নবীন তপস্বিনী, সধবার একাদশী, কামিনী। বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই রুপকারের জন্ম ১৮৩০ সালের ১০ এপ্রিল। ১ নভেম্বর ১৮৭৩ সালে আমরা হারাই এই গুণী নাট্যকারকে।

ভারত উপমহাদেশের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় ইংরেজ নীলকরেরা নীল চাষে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে। বগুড়া, রংপুর, যশোর, নদিয়া ইত্যাদি জেলায় নীল চাষ শুরু হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে নীলচাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় কৃষকেরা ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইংরেজ নীলকরেরা অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করার চেষ্টা করলে শুরু হয় নীল বিদ্রোহ। নীল চাষ না করার কারণে যখন চাষীদের উপর ভয়ানক নির্যাতন শুরু হয় তখন এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। এই সশস্ত্র বিপ্লব পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত নীলদর্পণ নাটকে উনিশ শতকের ইংরেজ বণিকদের এদেশের মানুষের উপর করা অত্যাচার ও নিপীড়নের বাস্তবধর্মী বর্ণনা পাওয়া যায়। এই নাটকে এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর করা অমানবিক নির্যাতনের চিত্র ফুটে ওঠে। তখনকার সময় অতিরিক্ত নীল চাষের ফলে ফসলি জমির অভাব দেখা দেওয়ায় কৃষকেরা ফসলের অভাবে না খেয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়।
নাটকটির শুরুতে দেখা যায় গোলক বসু বাংলাদেশের স্বরপুর নামে এক গ্রামের অধিবাসী। তিনি নিতান্তই একজন সহজ সরল মানুষ। গোলক বসুর ছেলে নবীনমাধব নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং তাদের সকল জমিতে নিলের দাদন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। একারণে গোলক বসুর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ইংরেজ নীলকরেরা তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। অপমান সহ্য করতে না পেরে গোলক বসু কারাগারে আত্মহত্যা করেন। এরপর জমির দাদন নিয়ে আলোচনার সময় নবীনমাধবের সাথে নীলকরের হাতাহাতি শুরু হয়। হাতাহাতির এক পর্যায়ে নবীনমাধব গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। নবীনমাধবের মৃত্যুর খবর শুনে তার মা উন্মাদিনী হয়ে তার ছোটভাই বিন্দুমাধবের স্ত্রী সরলাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসার পর তিনি সবকিছু বুঝতে পারেন। তখন তিনি গভীর চোঁট পেয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। নীলদর্পণ নাটকে দেখা যায় একের পর এক মৃত্যুর কাহিনী। নীলদর্পণ নাটকে আরো ফুটে ওঠে ইংরেজ নীলকরদের এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর করা অমানবিক নির্যাতনের বাস্তব চিত্র।

দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নাটকটি রচনার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সাধারণ মানুষের প্রতি করা শোষণ-নিপীড়নের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন। এই নাটকটি সমকালীন সমাজ জীবনের দলিল রূপে গৃহীত হয়েছে। এটিতে কুঠিয়ালদের দ্বারা অত্যাচারিত বাঙালির সমাজ জীবনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এটির সাফল্য দেশবাসীকে সকল ঘটনার প্রত্যক্ষ পরিচয় দিয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এই নাটক শান্তিপূর্ণ অথচ জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবার প্রেরণা জুগিয়েছে। রেভারেন্ড জেমস লং নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করায় নীল বিদ্রোহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। এখানেই নীলদর্পণ নাটকের ঐতিহাসিক তাৎপর্য।

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *