পর্যালোচক: কামরুল হাসান, গবর্নমেন্ট সায়েন্স হাই স্কুল সাহিত্য ক্লাব

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার আলোচ্য “পুতুল নাচের ইতিকথা” উপন্যাসে।

কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে সেও না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর।
– মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
(পুতুল নাচের ইতিকথা)

উপন্যাসের শুরু হারুঘোষের বজ্রাঘাতে অপমৃত্যুর ঘটনা এবং তালপুকুরে মাটির টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দর্শনে শশীর অতৃপ্তির মাধ্যমে সমাপ্তি। এরই মধ্যে দশবছর কালব্যাপী গাওদিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষের নিয়তির প্রতি আত্মসমর্পণ এবং কার্যকরণ বাস্তবতায় নাটকীয়তার সন্নিবেশ ঘটেছে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় “পুতুল নাচের ইতিকথা’য় হৃদয়ের ভাবাবেগের চেয়ে বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তি দিয়ে খণ্ডানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গাওদিয়া গ্রামের ভূগোল বাংলার চিরায়ত গ্রামের পরিচয় বহন। গাওদিয়া গ্রামে জমিদার শ্রেণি রয়েছে,রয়েছে সামন্তবাদ, দালালী-মহাজনী এবং দরিদ্র শ্রেণি। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের জমিদারী ও সামন্তবাদের পরিচয় খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। মূলত উপন্যাসের আখ্যান নরনারীর জটিল মনস্তত্ত্ব, ঘরকুনো জীবন, অন্ধকারাচ্ছন্ন দরিদ্র গ্রামীণ জীবন,সূর্যবিজ্ঞানে বিশ্বাস এবং কু-সংস্কারের ওপর নির্মিত।

উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই একটি পুতুলের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। বকুল তলায় পড়ে-থাকা ন্যাকড়া-জড়ানো পুতুলটি যে শ্রীনাথের মেয়ের পুতুল, তা বুঝতে পারে ডাক্তার শশী। আর সে এও অনুভব করতে পারে যে, ভোর বেলায় গ্রামের মেয়েরা পুতুলটিকে দেবতা-প্রেরিত বলে ভেবে নেবে। বলা যায়, একরকমভাবেই ঔপন্যাসিক শশী এবং গ্রামবাসীর মধ্যকার পার্থক্যের সুতো বেঁধে দেন।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শশী ডাক্তারকে ঘিরে কাহিনি আবর্তিত। অর্ন্তজগত এবং বর্হিজগতের দ্বন্দ্ব, চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণে ক্ষতবিক্ষত এবং শেকড়ের সুতোয় বাঁধা শশীর জীবন পাঠককূলে সহমর্মিতা পেলেও কুসুমের প্রেমে অক্ষমতা প্রকাশ, পিতা গোপালের সামন্তবাদী চিন্তাধারায় কুঠারাঘাত করতে না পারা, জীবনকে উপভোগ করার আক্ষেপ, যাদব পণ্ডিতের স্বেচ্ছায় মৃত্যু রহস্য প্রকাশ করতে না পেরে নিরব সাক্ষী থাকা; তার চরিত্র পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি।

কুসুম পরানের বৌ। উচ্ছল গ্রাম্য অবোধ অশিক্ষিত বধু কুসুম সাত বছর শশীর প্রেমে কাঙাল হয়ে নিজেকে নিবেদন করে অথচ কুসুমের আবেদনে শশী প্রশ্রয় দিলেও আহ্বানকে সচেতনভাবে অবজ্ঞা করে যায়।
কুসুম শশীর মাঝে উত্তাপ খোঁজে কিন্তু শশী জেনেও নির্বিকার অথচ শশী কুসুমের উচ্ছলতায় টান অনুভব করে, হাসিতে দুর্বল হয় এবং কুসুম তার ভাবনাকে আন্দোলিত করে। শশী কুসুমকে খুব করে পেতেও চায় না আবার হারাতেও বেদনা অনুভব করে। আসলে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতায় এই অসম প্রেমকে লেখকের স্থায়ী রূপদান সম্ভব ছিল না। নয় বছর অপেক্ষার পর নিস্তেজ কুসুম যখন গাওদিয়া ছেড়ে চিরতরে বাপের বাড়ি যাওয়ার মনোনিবেশ করে তখন কুসুমের জন্য শশী ব্যাকুল হয়ে পড়ে। শশী কুসুমকে আহ্বান করে তার সঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কুসুম প্রত্যাখ্যান করে।

“পুতুল নাচের ইতিকথা” উপন্যাসে পুতুল নাচের কোন চরিত্র বা কাহিনি নেই। মানুষের জীবন যেন পুতুলের মত। মানুষ নিজেই যেন পুতুল হয়ে নাচে আবার নিজেই সুতো টেনে ধরে রাখে। আবার কেউ যেন আড়ালে কলকাঠি নাড়ে। শশী পিষ্ট হয় ভেতর ও বাহিরের দ্বিধা দ্বন্দ্বে। একাকীত্ব শশীকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। গাওদিয়া ছেড়ে শশী চলে যেতে চাই বিলেত অথচ শশী যেতে পারে না, সে যেন সমাজ ও শৃঙ্খলের সুতোয় বাঁধা। কুসুমকে নিয়ে সে বাঁচতে চাই, গৎবাঁধা জীবনকে ঝেড়ে ফেলে সে চাই উপভোগ করতে অথচ তার ইচ্ছে বাস্তবে রূপায়িত হয় না। সমাজ ও সংস্কারের কাছে অসহায় আত্মসমর্পনে শশী যেন পুতুল হয়ে থাকে।

উপন্যাসের বিভিন্ন ঘটনা নিয়তি নির্ভর মনে হলেও বাস্তবিকই লেখক কার্যকরণ বাস্তবতার উপর বেশি নির্ভর করেছেন। বিন্দুর ট্রাজেডি নিয়তি নয় লৌকিক, যাদবের স্বেচ্ছা মৃত্যুও লৌকিক এবং মতি – কুমুদের জীবনকে উপভোগের বোহেমিয়ান জীবনও নিয়তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কার্যকরণ বাস্তবতা নির্দেশ করে। মতি ও কুমুদের প্রেম-অগোছালো জীবন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পথচলার মাঝে ভবঘুরো জীবনকে উপভোগ করার বাসনা পাঠকের হৃদয়কে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।

Comments (6)

  • ?s=96&d=mm&r=g

    Sidratun Muntaha Anha

    June 9, 2024

    Wow 😳

  • ?s=96&d=mm&r=g

    Afif

    June 9, 2024

    শশী এবং কুসুম উভয় কি মেয়ে চরিত্র?

  • ?s=96&d=mm&r=g

    Afrida Humayra Chowdhury

    June 9, 2024

    বইটি পড়া হয়নি। তবে এটা পড়ে পড়ার প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হলো। আসলেই মানুষের জীবন পুতুলের মতোই । পরীক্ষার পর বইটি পড়বো আশা করি।

  • ?s=96&d=mm&r=g

    Mobashera Farhana

    June 9, 2024

    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর
    “পুতুল নাচের ইতিকথা” উপন্যাসটির বুক রিভিউটি অসাধারণ ছিলো। ভালো লাগলো পড়ে। আশা করছি সামনে আরো বুক রিভিউ পাবো।

  • ?s=96&d=mm&r=g

    Silchi Mree

    June 9, 2024

    I appreciate how you used mirrored language at the end of your statement, reflecting what was said initially but in reverse. This effectively demonstrated the change in power dynamics. change in power dynamics.✨

  • ?s=96&d=mm&r=g

    Waliyha Xyarish Fiha

    June 9, 2024

    এতো সুন্দর করে পুতুল নাচের ইতিকথা বইটির কথাগুলো তুলে ধরার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *